শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতজীবী শ্রেণীর দাবিদাওকে জাতীয় প্রশ্ন হিশাবে তুলবার সক্ষমতা অর্জন জরুরি


তৈরি পোশাক কারখানা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। এই রপ্তানি খাতের ওপর আমাদের বৈদেশিক আয় নির্ভরশীল। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঘামে ও পরিশ্রমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয়। অথচ সবসময়ই তাদের মজুরি বাড়ানোর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়, শ্রমিকের রক্ত ঝরে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবি সব সময়ই উপেক্ষা করা হয়েছে। কেন?

ন্যুনতম মজুরি ইস্যুকে সর্বোচ্চ জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু হিশাবে গুরুত্ব না দিয়ে নিছকই শ্রমিক আর মালিকদের দরকষাকষির বিষয় হিসেবে দেখা যাবে না। এটা রাষ্ট্রের সহায়তায় মালিকপক্ষের এক তরফা সিদ্ধান্ত নেবার বিষয় না। একদিকে গার্মেন্ট শ্রমিক এবং পাশাপাশি বিদেশে ঘাম ও রক্ত উজাড় করে পাঠানো রেমিটেন্সই আমাদের অর্থনীতির খুঁটি। ফলে তৈরি পোশাক কারখানার মজুরি নির্ধারণ সরাসরি জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বিষয়। অতএব জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের প্রধান চ্যালেঞ্জ তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্ন।

বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণীর দয়ায় নয়। শ্রমিকদের কর্মশক্তি ও সংহতি সেই ক্ষেত্রে প্রধান পুঁজি। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং বিশ্ববাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলার আলোকেই শ্রমিকের প্রশ্ন মোকাবিলা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই ন্যূনতম মজুরির প্রশ্ন শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়ানো এবং শ্রমিকের কর্মশক্তি বৃদ্ধির আলোকে পরিকল্পিত জাতীয় নীতি প্রণয়নের বিষয়। ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ তাই জাতীয় নীতির বাইরের বিষয় না। মালিকপক্ষ এক তরফা সেটা নির্ণয় করতে পারে না। জাতীয় স্বার্থের আলোকেই ন্যুনতম মজুরির প্রশ্ন নির্ণয় করতে হবে। বিষয়টি স্রেফ শ্রমিক আর মালিক আর মালিকের পক্ষে রাষ্ট্রের দরকষাকষির জায়গা হিশাবে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশের শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।

এই ক্ষেত্রে বিমূর্ত ও নৈতিক ‘ন্যায্য মীমাংসা’ মার্কা তর্কও অর্থহীন। কারন আন্তর্জাতিক ভাবে শ্রমিকের অধিকার, কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সকল বিষয়েই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত অধিকার হিশাবে জাতিসংঘে গৃহীত হয়েই রয়েছে। আইএলও রয়েছে। কংক্রিট নির্দেশনা আছে। তাহলে ন্যায্য মীমাংসা মানে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত শ্রমিকের অধিকার মানতে মালিকপক্ষ এবং রাষ্ট্রকে বাধ্য করা শুধু শ্রমিকের নয় আমাদের সকলের কাজ। ন্যুনতম মজুরির প্রশ্নকে অতএব আলাদাভাবে শুধু শ্রমিকদের ব্যাপার ভাবলে চলবে না। এটা আমাদের সকলকেই ভাবতে হবে।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনে মজুরির প্রশ্ন সবসময়ই গুরুত্বপুর্ণ ও কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। অন্যান্য দাবি-দাওয়াগুলো, যেমন কাজের পরিবেশ, ওভারটাইম ইত্যাদি খণ্ড খণ্ডভাবে নানা সময়ে অবস্থাভেদে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু মজুরি নির্ধারণ শ্রমিকদের জন্য যতটুকু, তারচেয়েও অনেক বেশি রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের প্রধান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র হিসেবে হাজির হয়। এর মীমাংসার সঙ্গে শুধু শ্রমিকদের বাঁচামরার প্রশ্ন নয়, পুরো দেশের স্থিতি ও ভবিষ্যৎ জড়িত।

আমাদের নিজেদের টিকে থাকা না থাকা অবশ্যই শ্রমিকদের মজু্রি নির্ণয়ের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। কারন সমাজ বা রাষ্ট্র হাওয়ায় ভাসে না। সমাজের শ্রমশক্তিই সমাজকে টিকিয়ে রাখে। শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতজীবী শ্রেণীর প্রতি আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গী বাংলাদেশের সমাজে গড়ে উঠেছে তা প্রাচীন দাস ব্যবস্থাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

যদি এইটুকু আমরা বুঝি তাহলে রাজনীতি ও অর্থনীতির গোড়ার প্রশ্ন আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাই ভোটসর্বস্ব নির্বাচনবাদী রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা আমাদের বুঝতে হবে। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে আমাদের অবশ্যই ন্যূনতম মজুরির প্রশ্নকে জাতীয় রাজনীতির প্রধান বিষয় হিশাবে সামনে আনতে হবে।

বাংলাদেশের দাস ব্যবস্থা ভাঙতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণির ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে নতুন করে বাংলাদেশ গঠন করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশ নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলবার জন্য অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত বোধ করুক। সেই ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে ভোটের ব্যবসা বন্ধ করে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতজীবী শ্রেণীর দাবিদাওয়াকে জাতীয় প্রশ্ন হিশাবে তুলবার সক্ষমতা অর্জন করা। রাজনীতিকে গঠনমূলক তর্কবিতর্ক ও জাতীয় প্রশ্ন মীমাংসার ক্ষেত্রে পরিণত করা।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।